দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান কর্তৃক আকস্মিকভাবে পার্ল হারবার নৌ ঘাঁটি আক্রমণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের ভয়াবহতম সামরিক ক্ষয়ক্ষতি। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। এই হামলায় ১৯টি জাহাজ ডুবে যাওয়া/ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও ২,৪০৩ জন নিহত ও ১,১৩৮ জন আহত হয়।
পার্ল হারবার আক্রমণের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো। তিনি ছিলেন ইম্পেরিয়াল জাপানিজ নেভির কম্বাইন্ড ফ্লিটের সর্বাধিনায়ক এবং ক্ষুরধার মস্তিষ্কের তুখোড় মিলিটারি ট্যাক্টিশিয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পেছনে তার নেয়া অনেক অবদান রয়েছে। মিডওয়ে, কোরাল সি, স্যাভো আইল্যান্ড ইত্যাদি যুদ্ধে তিনি ছিলেন নেপথ্যের নায়ক। কিন্তু ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে গুয়াডালক্যানেল, নিউ গুয়েনা, সলোমন আইল্যান্ড ক্যাম্পেইনের একাধিক যুদ্ধে জাপান হেরে গিয়ে নাবিকদের মনোবল তখন তলানিতে। এ সময় ইয়ামামোতো বিভিন্ন জাপানি ঘাঁটি পরিদর্শন ও ভাষণ দিয়ে সেনাদের উজ্জীবিত করতে সফর শুরু করেন।
ঘটনাক্রমে একটি সফরের কথা জেনে যায় মার্কিন নৌবাহিনীর সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। যুক্তরাষ্ট্র জানতো যে ইয়ামামোতোর মতো টপ লেভেল এডমিরালকে হত্যার ফলে জাপানিদের মনোবল একলাফে বহুগুণ কমে যাবে। এছাড়া পার্ল হারবারের প্রতিশোধের ব্যাপার তো ছিলই। এজন্য তাকে হত্যার গোপন মিশন হাতে নেয়া হয়। এর নাম দেয়া হয় অপারেশন ভেনজেন্স!
পার্ল হারবার আক্রমণের পর থেকেই মার্কিন সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সকে শক্তিশালী করা হয়। নতুন করে গঠন করা হয় Military Intelligence Service (MIS)। এখানে ‘Nisei’ নামে পরিচিত সেকেন্ড জেনারেশন জাপানিজ-আমেরিকান নাগরিকরা ও জাপানি ভাষা জানা মার্কিনীদের রেডিওতে আড়ি পাতার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই ইউনিটে ছিলেন একদল দক্ষ ক্রিপ্টোগ্রাফার যারা জাপানিদের নেভাল কোডবুক JN-25 এর বেশিরভাগ অংশের অর্থ বের করে ফেলেছেন! এর ফলে এনক্রিপ্টেড জাপানি রেডিও মেসেজ তখন প্রায় পুরোটা বা আংশিক অনুবাদ করা সম্ভব হচ্ছিল। এসকল মেসেজ থেকে জাপানিদের অনেক তথ্য অগ্রিম জেনে গিয়ে মিত্রবাহিনী পাল্টা যুদ্ধকৌশল ঠিক করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্যাসিফিক থিয়েটারে একের পর এক মার্কিন বিজয়ের নেপথ্য কারিগর ছিলেন এই কোডব্রেকাররা।
এপ্রিলের শুরুতেই এডমিরাল ইয়ামামোতো সলোমন আইল্যান্ড, নিউ গুয়েনার জাপানি ঘাঁটিগুলোতে ইনস্পেকশন ট্যুরের সিদ্ধান্ত নেন। ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৩ সালে সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের জাপানিজ-আমেরিকান সৈনিক ‘হ্যারল্ড ফুদেন্না’ বিশেষ ধরনের রেডিও মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করেন। উক্ত মেসেজে ‘ম্যাজিক‘ শব্দটি বারবার ব্যবহৃত হতে দেখেন। তখনও ম্যাজিক এর অর্থ বের করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে মেসেজ নাম্বার NTF131755 এ জাপানের এগারো ও ছাব্বিশতম এয়ার ফ্লোটিলার দুটো বেজ ইউনিট কমান্ডারের মেসেজে ‘অমুক তারিখে ম্যাজিক আসবেন’ কথাটি জানা যায়।
এতক্ষণে তারা বুঝতে পারে যে ‘ম্যাজিক‘ আসলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যাকে দেখলে সাধারণ সৈনিকরা জাদুর মতো মোহাচ্ছন্ন হবে। সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের ক্রিপ্টোগ্রাফার জন পল স্টিভেন্স এর অর্থ বের করেন এই যে সম্ভবত এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো ঘাঁটিগুলো পরিদর্শনে আসবেন। কিন্তু তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেটি প্রথমে বিশ্বাস করেনি। ইয়ামামোতোর মতো হাই প্রোফাইল মিলিটারি কমান্ডারগণ সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে না এসে দূর থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু একই মেসেজ আলাস্কা-হাওয়াই দ্বীপের আরো তিনটি সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ইন্টারসেপ্ট করার পর স্টিভেন্সের ধারণা সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি কবে, কোথায়, কীভাবে, কোন বিমানে, কখন ইয়ামামোতো আসবেন- এর সবই রেডিওতে আড়ি পেতে মার্কিনিরা জানতে পারে!
এই বিষয়টি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নজরে আনা হলেও তিনি তাকে হত্যার জন্য সরাসরি কোনো এক্সকিউটিভ অর্ডার দেননি। তবে তার নেভাল সেক্রেটারি ফ্র্যাঙ্ক নক্সের সূত্রে অনেকেই প্রেসিডেন্টের আনঅফিশিয়াল অর্ডারের কথা বলেছেন যার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার প্যাসিফিক অঞ্চলের ফ্লিট কমান্ডার এডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিটজ এর উপর ছেড়ে দেয়া হয়। নিমিটজ তার সবচেয়ে বড় শত্রুকে শেষ করে দেয়ার ব্যাপারে ভাইস এডমিরাল উইলিয়াম হ্যালসির সাথে পরামর্শ করেন। কারণ ইয়ামামোতোকে হত্যা করা হলে জাপানিরা টের পেয়ে যাবে যে মার্কিন ক্রিপ্টোগ্রাফারগণ তাদের নেভাল কোডবুক ক্র্যাক করে ফেলেছে। যদি তারা এনক্রিপ্টেড কমিউনিকেশনের পদ্ধতি পরিবর্তন করে ফেলে তবে জাপানিদের কার্যক্রম সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার সবচেয়ে বড় উৎসটি বন্ধ হয়ে যাবে।
এডমিরাল নিমিটজ তাই এমনভাবে অপারেশন শুরু করেন যেন ইয়ামামোতো হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি দেখে বাংলা প্রবাদ “ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে” মনে হয়। এজন্য রেডিওতে ভুয়া গল্প ছড়ানো হয় যে অস্ট্রেলিয়ান কোস্ট ওয়াচার গোয়েন্দারা রাবাউলে একজন হাই র্যাঙ্কিং অফিসারকে আসতে দেখেছেন। মার্কিনিরা উক্ত অফিসার সম্পর্কে বিস্তারিত জানে না এমন তথ্যও ছড়ানো হয়। মার্কিনীরা জানতো এসব ভুয়া তথ্য অবশ্যই জাপানিরা আড়ি পেতে শুনে ফেলেছে। তাছাড়া হাই র্যাঙ্কিং অফিসার তো নিয়মিতই যাওয়া-আসা করে। কিন্তু ইয়ামামোতোর বিষয়টি যে ফাঁস হয়ে গেছে তা জাপানিরা জানতো না। মূলত তিনি নিহত হলে শত্রুর মনোবল ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া এবং তার জায়গায় তুলনামূলক কম দক্ষ এডমিরাল নেতৃত্বে আসবে জেনে প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ এই অপারেশন গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছিল।
এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতোর পরিকল্পনা ছিল ১৮ এপ্রিল, ১৯৪৩ সালে রাবাউল নৌঘাঁটি থেকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের বুগেনভাইল আইল্যান্ডের জাপানি নেভাল এয়ার ইউনিট পরিদর্শনে যাবেন। এই ইউনিটের পাইলটরা ৭ এপ্রিল থেকে চলা ‘অপারেশন আই-গো’তে লড়াই করছিল। সংক্ষিপ্ত এই ফ্লাইটের ব্যাপ্তি ছিল মাত্র দুই ঘন্টা। তাই ইয়ামামোতো ও তার চিফ অব স্টাফ ভাইস এডমিরাল মাতোমে উকাগিসহ অন্য স্টাফদের দুটি মিতসুবিশি জি-৪এম (ডাকনাম বেট্টি) বোমারু বিমানে করে বহন করা হচ্ছিল। তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছিল মিতসুবিশি এ-৬এম বিমান যা ‘জিরো’ ফাইটার’ নামেই অধিক পরিচিত।
মার্কিন রাডারে শনাক্ত হওয়া এড়াতে পানির উপর দিয়ে এমনভাবে উড়ে যাওয়ার ফ্লাইট প্ল্যান সাজানো হয় যেখানে মার্কিন বিমানঘাঁটির সাথে সবসময় ৪০০ মাইলের মতো দূরত্ব বজায় থাকে। এটি জানতে পেরে নৌবাহিনীর এফ-৪ ওয়াইল্ডক্যাট ফাইটার বাদ দিয়ে পি-৩৮ লাইটনিং বিমানকে মিশনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। কারণ বিমানগুলোকে যেতে ৬০০ মাইল, আসতে ৪০০ মাইল দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। অপারেশনাল রেঞ্জ বাড়ানোর জন্য পি-৩৮ বিমানগুলোর ডানায় ৬২০ লিটারের দুটো বাড়তি ফুয়েল ট্যাংক লাগানো যেত। কিন্তু এগুলো বিমানটির ম্যানুভার সক্ষমতা কমিয়ে দেয় যা জাপানি জিরো ফাইটারের জন্য সহজ টার্গেট। তাই ১,২০০ লিটারের বিশেষ ফুয়েল ট্যাংক নিউ গুয়েনা থেকে জরুরি ভিত্তিতে উড়িয়ে আনা হয়।
Posted ২:৫৯ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৭ জুলাই ২০২১
bbcjournal.com | rifat